
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতির এক অমোচনীয় অধ্যায় আজ শেষ হলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিনের বার্ধক্যজনিত জটিলতা ও অসুস্থতার পর মঙ্গলবার সকালে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সংবাদ সারাদেশে শোকের ঢেউ সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র-ছাত্রী সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছেন। নারায়ণগঞ্জের আইনের ছাত্র ফোরামের প্রথম সদস্য ফাতেমা আক্তার মাহমুদা ইভা, নারায়ণগঞ্জ জেলা মহিলা দলের সভাপতি রহিমা শরীফ মায়া, সোনারগাঁ থানা মহিলা দলের সভাপতি সালমা আক্তার, রূপগঞ্জ থানা মহিলা দলের সভাপতি হাওয়া বেগম এবং গোগনগর ইউনিয়ন মহিলা দলের সভাপতি পপি হোসাইন সহ অনেকে বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ়তা ও দেশের জন্য অবদানের কথা স্মরণ করেছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ও চিকিৎসাধীন থাকা এই প্রবীণ নেত্রী পরিবার, রাজনৈতিক সহযোগী ও শুভানুধ্যায়ীদের পরিবেষ্টনে প্রাণত্যাগ করেন। তার জানাজা আজ সকাল বাদ জোহর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হবে এবং এরপর তাকে শ্রদ্ধাবনত শ্রদ্ধায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
শৈশব ও ব্যক্তিগত জীবন
বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে সৌন্দর্য ও চঞ্চলতার জন্য তাকে পরিবারে ‘পুতুল’ নামে ডাকা হতো। তিনি শিক্ষা জীবন শুরু করেন দিনাজপুরের সেন্ট জোসেফ’স কনভেন্ট ও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ (Intermediate in Arts) পাস করেন। যদিও পরবর্তীতে সারাদেশীয় রাজনৈতিক নথিতে তিনি ‘স্বশিক্ষিত (Self-Educated)’ হিসেবে উল্লেখিত ছিলেন, তার ত্যাগ ও অধ্যবসায়ে তিনি ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলেন।
১৯৬০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পরিবার সংগে দিনাজপুরেই প্রথম বসতি স্থাপন করেন। বিয়ের প্রথম দিনের পর থেকেই খালেদা জিয়া জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন এবং ঘর-বাড়ি, সন্তান ও সমাজের বিভিন্ন দিক সামলাতে সক্ষম হন।
স্বাধীনতাযুদ্ধ ও সংগ্রাম
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে তার দুই সন্তান - তারেক ও আরাফাত সহ। ২ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী থেকে আটক করার পর ১৫ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের আগের দিন পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি ছিলেন। এই সংগ্রাম ও বন্দিত্বের সময়টি তাঁর জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে আজও ইতিহাসে গেঁথে রয়েছে।
রাজনৈতিক যাত্রা ও অর্জন
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার নাম অনন্য এক অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। যতবারই তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, কোনো আসনেই পরাজিত হননি। উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি এককভাবে পাঁচটি আসন জয় করেছিলেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল রেকর্ড।
১৯৯১ সালে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নির্বাচিত নারী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০১-এর দশকে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও গণতন্ত্রের পক্ষে বক্তৃতা রাখেন এবং ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেট সিনেট তাঁকে “Fighter for Democracy” (গণতন্ত্রের লড়াইকারী) হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে। এই সম্মাননা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতি তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত।
শেষ সময় ও শ্রদ্ধা
নিজ পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক সংগঠক ও চিকিৎসকের পরিবেষ্টনে আজ সকালে তিনি ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে হৃদয়ঘাতী অবসানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সংবাদ রাজনৈতিক নেতারা “দেশে একটি শূন্যতা তৈরি করেছে” বলে উল্লেখ করেছেন।
শুধু রাজনৈতিক সমর্থকরা নয়, সাধারণ মানুষও তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও সমষ্টিগত নেতৃত্বের জন্য গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও রাজনীতিবিদরা শোকবার্তায় বলেছেন, “তিনি ছিলেন শুধু একজন রাজনীতিবিদ নয়; তিনি ছিলেন দেশের মায়ের মত একজন অনুকরণের মানুষ।”
আজ বাংলাদেশ একটি সংগ্রামী নেত্রীকে হারাল; তার অবদান, আদর্শ ও সংগ্রামী মনোবল বাংলার ইতিহাসে চিরতরে স্মরণীয় হিসেবে থাকবে।

