ই-পেপার শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২

স্বাধীনতার স্বপ্ন ও পরিবারতন্ত্রের অভিশাপ

রহমান মৃধা:
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:১৩

বাংলাদেশ নামে পরিচিত একটি দেশ আমরা পেয়েছি, কিন্তু সকলের ভাগ্যে সেই স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া সম্ভব হয়নি। হবে কী করে? শুরু থেকেই আমাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব ও দ্বিমত ছিল। পরে স্বাধীনতার স্বাদ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে পরিবারতন্ত্রে, আর শেষ পর্যন্ত থেমে যায় স্বৈরশাসকের হাতে।

দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকালে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে কার্যত বলি দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কায়েম করেছিলেন। ঘুম, খুন, ভোটচুরি, দমন–পীড়ন—সবই ঘটেছে তার আমলে। অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। নতুন রক্তের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতি সেদিন এক নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পায়, যদিও সেই অর্জন কতদিন স্থায়ী হবে—সন্দেহ রয়ে গেছে।

শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনার শাসনকাল পর্যন্ত সময়টুকু আমার কাছে জাতির জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং এক অপ্রিয় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে স্বপ্ন ও আশার আলো নিয়ে জনগণ স্বাধীনতার পথে রক্ত দিয়েছিল, সেই আলো নিভে গেছে পরিবারতন্ত্র, স্বৈরাচার ও দুর্নীতির অন্ধকারে। দুঃখের বিষয়, এই দীর্ঘ যাত্রায় কোথাও অনুশোচনার ছায়া নেই। শেখ হাসিনার উচিৎ ছিলো ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া, কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি পাপের বোঝা ভারি করেছেন আরও বেশি করে। আজ তিনি পার্শ্ববর্তী দেশে বসবাস করছেন, অথচ আওয়ামী লীগের সমর্থকগোষ্ঠীর ভেতরও কোনো অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনার চিহ্ন দেখা যায় না—এটাই আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট।

ফুল তার গন্ধ ও সৌন্দর্য নিয়ে একসময় ঝরে পড়ে—ঠিক যেমন যারা দেশটিকে ভালোবেসে স্বাধীন করেছিল, তারা ফুলের মতো ঝরে পড়েছে, কিন্তু রেখে গেছে স্মৃতি। কিছু স্মৃতি মায়ামমতায় ভরা, কিছু ঘৃণা ও বিদ্বেষে, আর কিছু করুণার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ঝরা ফুলের স্মৃতি কখনও শেষ নয়। যারা স্বপ্ন দেখেছিল, যারা ভালোবেসেছিল, তারা আমাদের মনে রেখে গেছে গন্ধ, রঙ, সৌন্দর্য এবং ত্যাগের গল্প।

দেশের নতুন রক্ত, নতুন প্রজন্ম, নতুন চিন্তা—এরা যদি স্মৃতি থেকে শিক্ষা নেয়, ভুলকে পুনরাবৃত্তি না করে, তবে ঝরা ফুল যে বীজ বপন করেছে, তা আবার ফুঁটি উঠবে। স্বাধীনতা কেবল নাম নয়; এটি চেতনা, সংগ্রাম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মিলন। আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের দায়িত্ব হলো সেই ফুলের গন্ধ ও সৌন্দর্য ধরে রাখা, ইতিহাসকে সম্মান করা, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নতুন আলো বপন করা।

ফুলের মতো যারা ঝরে পড়েছে, তারা কি শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, স্মৃতির আলো ছড়াচ্ছে? নাকি আমাদের ব্যর্থতায় দুঃখও পাচ্ছে? আজও আমাদের দেশে দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার মতো বাস্তব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। শিক্ষিত যুবকরা সুযোগের অভাবে হতাশ, কৃষক ও শ্রমিকরা দারিদ্র্যের শিকলে আটকে আছে। স্বপ্ন আর সংগ্রামের মাঝেই এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ঝরা ফুলের স্মৃতিকে শুধু পূজার মতো নয়, সতর্কতার আলো হিসেবেও ধারণ করতে হবে।

অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ : দেশের অর্থনীতি আজ নানা সমস্যার মুখোমুখি। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট, বাজারের অস্থিতিশীলতা, শিল্প ও কৃষিখাতের সীমাবদ্ধতা—এসব দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর সমাধান সম্ভব কার্যকর প্রশাসন, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে কেন্দ্রীয় নীতি পর্যন্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার রোধে শক্তিশালী ব্যবস্থা অপরিহার্য।

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন : ডিজিটাল প্রযুক্তি, ডেটা অ্যানালিটিকস, স্মার্ট কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের উন্নয়নে ক্রান্তিকালীন ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সামাজিক সেবা উন্নত করা সম্ভব।

নতুন প্রজন্মের ভূমিকা : যুবশক্তি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও এনার্জিকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু শিক্ষায় নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান, নেতৃত্ব, সামাজিক উদ্যোগ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

শিক্ষা ও মানবসম্পদ : শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন অপরিহার্য। নৈতিক মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

সামাজিক ন্যায় ও সমতা : দারিদ্র্য, বৈষম্য ও লিঙ্গ বা সামাজিক অসাম্য রোধ করা অপরিহার্য। নতুন প্রজন্মকে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়, সামাজিক ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত করতে হবে।

পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন : জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও কৃষিক্ষেত্রের অবস্থা, শহর ও গ্রামীণ এলাকায় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। প্রযুক্তি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান গড়তে হবে।

স্থানীয় উদ্যোগ ও স্টার্টআপ : গ্রামীণ প্রযুক্তি, ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও নতুন ব্যবসা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। নতুন প্রজন্মের উদ্ভাবনী চিন্তা ও এনার্জি স্থানীয় সমস্যার সমাধানে কাজে লাগানো উচিত।

রাজনৈতিক সংস্কার ও অংশগ্রহণ : জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ভোট ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্ব, পর্যবেক্ষণ ও নীতি নির্ধারণে যুক্ত করতে হবে।

চূড়ান্ত বার্তা : আমরা যারা বেঁচে আছি, সেই আলোয় পথ খুঁজে নতুন ফুল ফোটাতে চাই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের শক্তি, উদ্ভাবনী চিন্তা, সততা ও দায়িত্ব একত্রিত না হলে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রযুক্তি, প্রশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায় ও পরিবেশ—এসব উপাদান সমন্বিতভাবে কাজ করলে ঝরা ফুলের বীজ শুধু ফুঁটি উঠবে না, বরং টেকসই, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশের ভিত্তি গড়বে।

আমরা সবাই একদিন ফুলের মতো ঝরে যাবো—এটাই জীবনের নিয়ম। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি ফুলের সৌন্দর্য, গন্ধ আর আলো রেখে যাবো, নাকি ধ্বংস, লুটপাট ও ব্যর্থতার স্মৃতিই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দেবো? যারা ফুলের মতো ঝরে পড়েছে, তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছে না, তারা আমাদের সতর্কও করছে—এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কেমন উত্তরাধিকার রেখে যাবো।

এই দীর্ঘ ট্রাজেডির পরও আমাদের জাতি হিসেবে শিক্ষা নিতে হবে—আমরা আর কোনো পরিস্থিতিতেই পরিবারতন্ত্রকে বাংলাদেশে জায়গা দেবো না। কারণ একই ভুল আমরা আর কখনোই করতে পারি না। একটি ফুলকে বাঁচাতে হলে যেমন যত্ন, ভালোবাসা ও সুরক্ষা প্রয়োজন, তেমনি একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ—যেখানে জনগণের অধিকার, ন্যায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা অবিচল লড়াই করব। এটাই হবে ঝরা ফুলের প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় সম্মান।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

আমার বার্তা/জেএইচ

বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান

বর্তমান বিশ্ব এক জটিল, দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং মেরুকৃত ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”: উন্নয়ন না ঋণের ফাঁদ?

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে যখন “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” বা সংক্ষেপে BRI ঘোষণা

জুলাই সনদ ও গণভোট : গণতন্ত্র রক্ষায় বিএনপির সতর্ক অবস্থান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও দুটি শব্দ কেন্দ্রবিন্দুতে—‘সংস্কার কমিশন’ এবং ‘গণভোট’। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি সংবিধান সংস্কারের

রাজনীতির অস্থিরতার ফাঁদে চট্টগ্রাম বন্দর!

ষাটোর্ধ মোহাম্মদ সেকান্দর। তাকে অপহরণ করার ঘটনায় আৎকে উঠি। সীতাকুণ্ডের পরিচিত মুখ সেকান্দর। বয়সে আমাদের
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

 ‘বয়কট বয়কট-ফজলে হুদা বয়কট’ শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল নওগাঁ-৩ 

সেন্টমার্টিন অঞ্চলে অবৈধ ট্রলিং বোটসহ ১৯ জেলে আটক

ডিসেম্বরের শুরুতেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে: সালাহউদ্দিন

কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এই সরকারের কাজ নয়: তারেক রহমান

রোববার থেকে সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

শাহবাগে প্রাথমিক শিক্ষকদের সমাবেশ ছত্রভঙ্গে ডিএমপির ব্যাখ্যা

শাহবাগে প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, আহত ১২০

৫ দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি জামায়াতসহ ৮ দলের

কিছু দল নির্বাচন বিলম্বিত করে ক্ষমতার স্বাদ নিতে চায়: মেজর হাফিজ

নীরবে কানাডা গেলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন

তারেক রহমানের দেশে আসার সময় জানালেন ফজলে এলাহী

প্রাসঙ্গিক থাকতে বিচার বিভাগকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে: প্রধান বিচারপতি

ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা শিক্ষকদের, জলকামান-সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

ফ্যাসিবাদগোষ্ঠি নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে জনগণই প্রতিরোধ করবে: আইজিপি

কলম বিসর্জন দিতে শহীদ মিনার থেকে শাহবাগে যাচ্ছেন শিক্ষকরা

পেঁয়াজের দামে লাগাম টানতে আমদানির সুপারিশ ট‍্যারিফ কমিশনের

শিক্ষকদের আন্দোলনে পড়াশোনার ক্ষতি হলে কঠোর ব্যবস্থা: গণশিক্ষা উপদেষ্টা

দুই কোটি টাকা দিয়ে নিবন্ধন পেয়েছে ডেসটিনির আম জনগণ পার্টি: তারেক

রাজনীতি স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতি আরও ভালো চলবে: গভর্নর

আসিয়ান: উচ্চশিক্ষা ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে পুত্রজায়া